![]() |
ওয়েব নিউজ |
ফ্রান্সের এক টুকরো বাংলাদেশ, আর সেই বাংলাদেশের টুকরোর মাঝখানে অবস্থিত ‘বাংলাদেশি জামে মসজিদ’। কেউ কেউ আদর করে বলেন “ওভারলোর্ড মসজিদ”, কারণ এখানে প্রেসিডেন্ট বদলায় না, বদলায় না খাদেম, এমনকি বদলায় না সেই জুমার আগে অনন্তকাল ধরে চলা বকবকানিও।
এই মসজিদের ইতিহাস জানতে চাইলে পুরাতন প্রবাসীরা একটু চুপ করে, অতীত স্মরণে চোখ বড় করে বলেন—“বাংলাদেশি জামে মসজিদ ফ্রান্সে বসবাসরত প্রবাসীদের রক্ত-ঘামে অর্জিত টাকায় কেনা। এটা আমাদের আত্মার অংশ।” ১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু হলেও, নামাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। আর জুমার নামাজ চালু হয় ২০০৬ সালে। এর মাঝের বছরগুলোতে মসজিদ ছিল গড়ে ওঠার অপেক্ষায়—কিন্তু যে অপেক্ষার শেষ হয়নি তা হলো নেতৃত্বের পরিবর্তন।
প্রবাসীদের একাংশ বলেন, “আমরা বিশ্বাস করে কয়েকজনের নামে মসজিদের জমির রেজিস্ট্রি করে দিই, যেন মসজিদের কাজ ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু সেই আস্থা থেকেই শুরু হয় সবচেয়ে বড় 'মির্জাপুরী'—ব্যক্তিগত নামে কেনা মসজিদের মালিকানা, আর সেখান থেকেই শুরু এক ‘চিরস্থায়ী সরকার’-এর গল্প।”
মসজিদের প্রেসিডেন্ট আর চিরস্মরণীয় খাদেম সাহেব যেন আজীবনের জন্য সিংহাসনে বসে থাকেন, সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে বেশ কায়দা করে। আশেপাশে সবসময় ঘুরঘুর করে একদল ভক্ত বাহিনী—নাম না থাকলেও কাজ একদম নিরাপত্তা বাহিনীর মত! কেউ যদি ভুল করে প্রশ্ন তোলে, "এই যে হিসাবটা একটু দেখাইবেন?" কিংবা সাহস করে বলে ফেলে, "ভাই, এভাবে চললে তো সমস্যা!"—তখনই শুরু হয় অ্যাকশন মুভি। প্রেসিডেন্ট-খাদেম কম্বোর ‘ক্যাডার ইউনিট’ ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন মসজিদ নয়, রাজত্ব চলছে!
সবকিছু বদলেছে—সময়, প্রজন্ম, এমনকি আশেপাশের মসজিদগুলোও আধুনিক হয়েছে। কিন্তু যেটা কখনো বদলায়নি, সেটা হলো মসজিদের প্রেসিডেন্ট আর খাদেমের চেয়ার।
একজন প্রবীণ প্রবাসী ব্যঙ্গ করে বলেন,“এমন মজবুত চেয়ার ফ্রান্সেও দেখা যায় না—একবার বসলে আর উঠার প্রয়োজন পড়ে না!” প্রবাসীরা ঠাট্টা করে বলেন, “মসজিদটি চলছে এমন এক শাসন ব্যবস্থায়, যেখানে প্রেসিডেন্ট পদ আজীবনের জন্য বরাদ্দ, আর খাদেম সাহেব হলেন মাইক্রোফোনের একচ্ছত্র অধিপতি!”
মালিকানা, না কি ব্যক্তিগত সম্পত্তি?
কমিউনিটির অভিযোগ, এই মসজিদের জমি এসোসিয়েশনের নামে নয়, বরং কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত নামে। ফলে কেউ কিছু বললেই কৌশলে উত্তর আসে, “এটা আমাদের ব্যাপার, আপনি নামাজ পড়ুন, প্রশ্ন তুলবেন না।” এই অদ্ভুত ‘পবিত্র প্রাইভেট প্রপার্টি’ পলিসির কারণে প্রবাসীরা প্রশ্ন তুলতে ভয় পান, কারণ প্রশ্ন মানেই হয় ‘দুর্বিনীত’, নয়তো ‘বিতাড়িত’।
খাদেম সাহেবের খতবা, না কি রেডিও টকশো?
মসজিদের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো—জুমার প্রতিটি নামাজের আগের ১৫-২০ মিনিটের ঐতিহ্যবাহী ‘বকবকানুষ্ঠান’। প্রবাসীরা এটিকে মসজিদের "সাপ্তাহিক চর্মরোগ" হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কর্মজীবী মুসল্লিরা একটু দেরি করলে নামাজ না পড়েই কাজে চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু খাদেম মহোদয় তো খাদেম নন, তিনি যেন 'মাইক হিরো'—তাকে থামাবে কে?
দানের টাকা যায় কোথায়?
মসজিদের দান বাক্স যেন এক রহস্যের খনি। প্রতি শুক্রবার এবং প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্তের নামাজে বেশ কিছু ইউরো জমে এই বাক্সে, কিন্তু তার কোনো হিসাব আজ পর্যন্ত জনসমক্ষে আসেনি। কেউ যদি জানতে চায়, জবাব মেলে—"আপনি কী আমাদের বিশ্বাস করেন না? তাহলে মসজিদে আসা বন্ধ করে দিন!"
এমনকি প্রবাসীদের অভিযোগ আছে, এই অর্থ ব্যবহৃত হয় ‘ব্যক্তিগত পকেট ভারী করার কাজে’, মসজিদের উন্নয়নে নয়। অথচ বছর চারেক আগে বলা হয়েছিল, "আরো কিছু টাকা হলেই মসজিদ সংস্কার হবে, জায়গা বড় হবে।" সাত-আট বছর কেটে গেছে, উন্নয়ন নেই—শুধু 'গরমিল' আর 'গল্প'।
ইমাম সাহেবরাও সন্দেহের বাইরে নন-
ইমামদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ—দানের টাকায় ব্যবসা, মাদ্রাসা চালানো নিয়ে স্বজনপ্রীতি, এমনকি মসজিদ ব্যবস্থাপনাকে ‘বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে’ রূপান্তর করার অভিযোগও শোনা যাচ্ছে।কেউ বলছেন, তাঁরা আছেন সাইলেন্ট মোডে, আবার কেউ বলছেন তাঁরা "মসজিদের শোরুমে থাকা ফিগার" মাত্র। অথচ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এই ধরণের কর্মকাণ্ড প্রবাসীদের মানসিকভাবে আঘাত করে।
একটি সত্যিকারের কমিউনিটি মসজিদ-
ফ্রান্সেই আরেকটি বাংলাদেশি মসজিদ রয়েছে, যেখানে রয়েছে হিসাবরক্ষক, নিয়মিত অডিট ও কমিউনিটির অংশগ্রহণ। মসজিদটি দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, জায়গা বাড়ছে, উন্নয়ন হচ্ছে দৃশ্যমান। এই মসজিদটি প্রমাণ করেছে—যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আছে, সেখানেই আলোর পথ।
যুবসমাজের আহ্বান: সময় এসেছে পরিবর্তনের-
ফ্রান্সের সচেতন যুবসমাজ বলছে, “মসজিদটিকে ব্যক্তিগত মালিকানার বাইরে এনে মসজিদের এসোসিয়েশনের নামে রেজিস্ট্রেশন করে একটি নতুন কমিটি গঠন করে দিলে।” তাদের বিশ্বাস, “এই মসজিদকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলা সম্ভব, যদি সুযোগ দেওয়া হয়।”
বাংলাদেশি জামে মসজিদের বর্তমান অবস্থা অনেকটা ‘চিরস্থায়ী সরকার’-এর রূপ নিয়েছে। যেখানে প্রশ্ন করলে ধর্মীয় অনুভূতির অভিযোগ তোলা হয়, আর স্বচ্ছতা চাইলে পথ দেখিয়ে দেওয়া হয় দরজার দিকে। অথচ একটি মসজিদ হওয়া উচিত পারস্পরিক বিশ্বাস, দায়বদ্ধতা এবং কমিউনিটির সম্মিলিত প্রয়াসের প্রতীক। এখন প্রশ্ন একটাই—এই অন্ধকার থেকে আলোতে ফেরার ইচ্ছা কি কারো আছে?