দেশে দেশে বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিতে ভোটারের সংখ্যা ক্রমশ বাড়িলেও ভোটের প্রতি ভোটারের আস্থাহীনতা দিনদিন বৃদ্ধি পাইতেছে উদ্বেগজনকভাবে। গণতন্ত্রের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য এই পরিস্থিতি মোটেও সুখকর নহে। বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের আস্থা ফিরাইয়া আনিবার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের; কিন্তু কমিশন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়া দায়সারা গোছের এমনকি পক্ষপাতদুষ্ট ও বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করিয়া চলিয়াছে। এই সকল দেশে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সুষ্ঠু পরিবেশ যেমন তৈরি করিতে পারিতেছে না, তেমনি ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো প্রতিকার করিতে পারিতেছে না। স্থানীয় সরকার কিংবা জাতীয় নির্বাচনে হাতেনাতে অনিয়ম ধরা পড়িবার পরও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা না লইয়া তাহা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিচারের ভার তুলিয়া দিতেছে এবং শেষ পর্যন্ত তাহাতে কোনো বিহিত হইতেছে না। ইহাতে প্রতীয়মান হয়, নির্বাচনের লাটাইটা শেষ পর্যন্ত তাহাদের হাতেই থাকে না। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি স্পর্শকাতর বিভাগের হাতে নির্বাচন আয়োজনের নিয়ন্ত্রণটা চলিয়া যাইবার কারণে তাহাদের প্রধান কাজ হয় নির্বাচনের সরঞ্জামাদি সরবরাহ ও ফলাফল ঘোষণা করা।
উন্নয়নশীল দেশে নির্বাচন কমিশনগুলি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপক্ষে, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করিতে ব্যর্থ হইতেছে কেন? ইহার মূল কারণ হইল—তাহাদের নতজানু নীতি এবং সাংবিধানিক ক্ষমতা পাইয়াও অনেক সময় সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গা-ছাড়া ভাব প্রদর্শন করা। মানুষ লাইন দিয়া ভোট দিতে গিয়া যখন দেখে তাহাদের ভোট অন্য কেহ দিয়া ফেলিয়াছে কিংবা তাহাদের সম্মুখে বিকল্প ও শক্তিশালী প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ হাজির করা হয় নাই, তখন স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনের প্রতি তাহাদের তৈরি হয় বিতৃষ্ণা। বিশেষ করিয়া এই সকল দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া পালন করে ন্যক্কারজনক ভূমিকা। নির্বাচনের পূর্বে ও নির্বাচনের দিন প্রতিপক্ষের লোকদের উপর যেইভাবে ধরপাকড়, গ্রেফতার ও হয়রানি চলে এবং ভীতিকর পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, তাহা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বড় প্রতিবন্ধক।
এই সমস্ত দেশে এই পরিস্থিতি চলিতে থাকিলে ভবিষ্যতে যদি এক জনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন, তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছু থাকিবে না। তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হইবার পথ আরো অবারিত হইবে। অথচ নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত শক্তিশালী প্রার্থীদের কারণে জিতিবার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থাকা। কোনো কোনো দেশে এই পরিস্থিতিও তৈরি হয় যে, ভোট শেষ পর্যন্ত সরকারি দল, তদীয় সমর্থিত কৌশলগত বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা জোট নেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হইয়া পড়ে। অবিশ্বাস্য সত্য হইল, তাহার পরও নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। ইহাতেও দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অযাচিত হস্তক্ষেপ। এইখানে নিজেদের জোটসমর্থিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়া যেমন অন্যায় ও বেমানান, তেমনি এইরূপ ভোটেও পুকুরচুরি, কারচুপি ও জালিয়াতি সেই নির্বাচনকে করিয়া তোলে হাস্যকর। দুর্ভাগ্যের বিষয় হইল, এই সমস্ত দেশে আবার এই সকল অপকর্ম সমর্থনে আগাইয়া আসে তথাকথিত আঞ্চলিক শক্তি। বিপক্ষের ছোট-বড় দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও সাজানো মামলা দিয়া এমনভাবে পর্যুদস্ত করা হয় যে, সেই সকল দলের পক্ষে তখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা নির্বাচন পরিচালনার মতো আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীর উপস্থিতি দেখা যায় না। আরো পরিতাপের বিষয়, এই পরিস্থিতিতে তাহারা শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়িয়া দেন এবং নির্বাচন বয়কটের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত লইয়া ক্ষমতাসীন দলের পাতানো ফাঁদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। ইহা কেমন কথা? নির্বাচন সুষ্ঠু হয় নাই—এই কথা বলিতে ও প্রমাণ করিতে হইলেও তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অপরিহার্য। তাহার পর না হয় সচেতন দেশবাসী বা আগ্রহী পৃথিবীবাসী তাহা বিচার-বিবেচনা করিয়া দেখিবেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যারি ডায়মন্ড মনে করেন যে, ২০০৬ সালের পর হইতে বিশ্বে গণতন্ত্রের যাত্রা হোঁচট খাইতে শুরু করিয়াছে। আগামী বিশ্বে কর্তৃত্ববাদের বিশ্বরূপ কেমন হইবে তাহা লইয়াও চলিতেছে আলাপ-আলোচনা। তবে এই ব্যাপারে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এখনো আশাবাদী। এই পৃথিবীতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে বলিতে গিয়া তিনি বলেন, ‘ডেমোক্রেসি উইল উইন ইফ উই ফাইট ফর ইট’। অর্থাত্ পৃথিবীতে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ধরিয়া রাখিতে হইলে আমাদের অবিরাম লড়াই করিয়া যাইতে হইবে। এতদ্ব্যতীত ইহা একসময় ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীর করতালগত হইয়া যাইতে পারে। যেইখানে আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষ এই ব্যাপারে সচেতন ও সদাজাগ্রত, সেইখানে এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকিবার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদাসীনতা লক্ষণীয়। অতএব, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভোটারের অব্যাহত লড়াই ও সংগ্রামের কোনো বিকল্প নাই।