![]() |
ওয়েব নিউজ |
উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য চেয়ে আবেদন করার জেরে এক সাংবাদিককে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়ে জেলে পাঠানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে৷
অভিযোগ শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া উম্মুল বানিনের বিরুদ্ধে৷ কারাগারে আটক ওই সাংবাদিকের নাম শফিউজ্জামান রানা। তিনি দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার নকলা উপজেলা প্রতিনিধি।
বিষয়টিকে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি হুমকি উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা৷ তারা বলছেন, এমন ঘটনায় ব্যক্তিস্বার্থে আইন-আদালত ব্যবহার হয়েছে৷ যদিও ইউএনও এমন দাবি অস্বীকার করছেন৷
এদিকে সাংবাদিক নেতারা অবিলম্বে এই সাংবাদিক দেওয়ার না হলে আন্দোলন নামার কথা জানিয়েছেন৷
ঘটনার তদন্ত করার কথা জানিয়েছে তথ্য কমিশন৷
সাংবাদিকের স্ত্রী বন্যা আক্তার বলেন, ‘‘গত মঙ্গলবার তিনি (শফিউজ্জামান রানা) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে তথ্য সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন৷ আগেই তিনি এজন্য তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিলেন৷ আমার কাছে ওই আবেদনের একটি কপি আছে৷ তাতে তিনি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বিভিন্ন প্রকল্পের কম্পিউটার ও ল্যাপটপ কেনাসহ আরো কিছু তথ্য চেয়েছিলেন৷ ওই দিন দুপুরে ওই তথ্য পাওয় না পাওয়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে ইউএনও মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেন৷’’
‘‘আমি তার এখনো জামিনের ব্যবস্থা করাতে পারিনি৷ কারাগারে গিয়ে দেখা করেছি৷ তিনি কারাগারে থাকলে আমার দুই সন্তান নিয়ে বিপদে পড়ে যাব৷ তিনি ছাড়া আমাদের পরিবারে উপার্জন করার আর কেউ নেই৷ তাকে অন্যায়ভাবে আটক করা হয়েছে৷ আমি তার মুক্তি চাই,’’ বলেন বন্যা আক্তার৷
তবে ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন দাবি করেন, ‘‘তথ্য চাওয়ার কারণে নয়, তিনি আমার সহকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা
শিলা আক্তারের সঙ্গে অশোভন আচরন করেন৷ তিান নিজেই তার রুমে ঢুকে ফাইলপত্র ধরেন৷ আমি তখন পাশের রুমে একটি মিটিংয়ে ছিলাম৷ বাইরে প্রচন্ড হট্টগোল হচ্ছিল৷ কয়েকজন রানা সাহেবকে থামানোর চেষ্টা করেন৷ আমি বের হয়ে দেখি তাকে কোনোভাবে থামানো যাচ্ছিল না৷ সে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলছিলো৷ তখন আমি আমার এসি ল্যান্ডকে ডাকি৷ সে এসেও থামাতে পারেনি৷ তারপর আমার গোপন সহকারির অভিযোগের ভিত্তিতে মোবাইল কোর্ট তাকে ছয় মাসের কারদণ্ড দেয়৷ অফিস চালানোর জন্য এছাড়া আমার উপায় ছিলো না৷ তিনি চলে গেলে তাকে শাস্তি দেয়া হতো না৷’’
তবে তিনি স্বীকার করেন, ওই সাংবাদিক তথ্যের জন্য আবেদন করেছিলেন৷ ইউএনও বলেন, ‘‘তিনি (শফিউজ্জামান রানা) এডিপি ও জাইকা প্রকল্পের তথ্যের জন্য আবেদন করেছিলেন৷ কিন্তু আমি এখানে এসেছি ছয় মাস হলো৷ ওই ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে আমি এখনো কাজ করিনি৷ আর আগের তথ্য আমার কাছে নাই৷ ওটা জাইকার কাছে থাকে৷’’
ইউএনও যেই এসি ল্যান্ডকে ডেকে আনেন তার নাম মো. শিহাবুল আরিফ৷ নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে তিনিই তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সাংবাদিককে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাকে সাংবাদিক হিসাবে নয়, ব্যক্তি হিসাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে৷ ইউএনও স্যারের সহকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তার অভিযোগের ভিত্তিতে মোবাইল কোর্ট কাজ করেছে৷ তথ্য চাওয়ার বিষয় তখন আমি জানতাম না৷ তথ্য চাওয়ার বিষয়টি পরে আমি পত্রিকায় দেখেছি৷ এ ব্যাপারে ইউএনও স্যারের সঙ্গে কথা বললে ভালো হবে৷’’
জানা গেছে, ওই দিন ঘটনার সময় সেখানে সাংবাদিক রানার দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে শাহরিয়ার জামান মাহিনও ছিলো৷
মাহিন জানায়, ‘‘আমার একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আব্বুর সঙ্গে বের হয়েছিলাম৷ দুপুর ১২টার দিকে বাবা ইউএনও ম্যামের কাছে তথ্যের আবেদন নিয়ে যান৷ তখন তিনি মিটিংয়ে ছিলেন তাই শীলা ম্যামের কাছে পাঠান৷ আব্বু রিসিভড কপি চাচ্ছিলেন৷ তখন তিনি ফি চান৷ এটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়৷ এক পর্যায়ে ইউএনও ম্যাম বের হয়ে গালাগাল করেন৷ আমাকেও বলেন, তুমি কি তোমার বাবার মত চোর সাংবাদিক হবে? এরপর মোবাইল কোর্ট বসিয়ে শাস্তি দেন৷ প্রথমে একটি এবং পরে আরেকটি মামলা দেয়া হয়৷ মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে৷ কিন্তু আব্বু দেননি৷’’
সাংবাদিক রানার স্ত্রী বন্যা আক্তার বলেন, ‘‘আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে মোবাইল কোর্টে শাস্তি দেয়া হয়েছে৷ কারণ তিনি যেসব তথ্য চেয়েছিলেন তা প্রকাশ হলে অনেকের দুর্নীতির খবর ফাঁস হতো৷ অনেক সাংবাদিক তা চেপে গেলেও আমরা স্বামী সব সময় তা প্রকাশ করেন৷''
আর নকলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘‘আমরা বিব্রত৷ তাকে মোবাইল কোর্টে শাস্তি দেয়াও যেমন ঠিক হয়নি৷ আবার সাংবাদিক যে আচরণ করেছে তাও ঠিক হয়নি৷’’
সাংবদিক দমনে মোবাইল কোর্ট?
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘এখানে মেবাইল কোর্টকে ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে৷ এটা বেআইনি এবং অন্যায়৷ আদালতকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার এটা একটা নজির৷ যারা এটা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷ ওই সাংবাদিক কোনো অপরাধ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে থানায় নিয়মিত মামলা করা যেত৷’’
তার কথা, ‘‘এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি হুমকি৷’’
আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘‘এটাই প্রথম নয়, এর আগেও ইউএনও এবং ডিসিরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট ব্যবহার করে শাস্তি দিয়েছেন৷ দেশে দুর্নীতি ছেয়ে গেছে৷ সাংবাদিকদের তথ্য দিলে দুর্নীতি প্রকাশ হয়ে যাবে তাই তারা তথ্য দিতে চান না৷ উল্টো মামলা দিয়ে, শাস্তি দিয়ে হয়রানি করেন৷’’
মোবাইল কোর্ট আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘‘এভাবে ব্যক্তিস্বার্থে আইন আদালত ব্যবহার হলে দেশে তো আর আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না৷’’
তবে ইউএনও এবং নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট দাবি করেছেন, তারা ব্যক্তি আক্রোশের কারণে মেবাইল কোর্ট ব্যবহার করেননি৷ আইনে তারা পারেন বলেই ব্যবহার করেছেন৷
আন্দোলনের হুমকি সাংবাদিক নেতার
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘‘সাংবাদিক রানাকে মেবাইল কোর্টে শাস্তি দিয়ে কারাগারে পাঠানো অন্যায়৷ আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং মুক্তি দাবি করছি৷ তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া না হলে যারা এই অন্যায় করেছেন তাদের বিচারের দাবিতে আমরা আন্দোলনে নামব৷’’
তার কথা, ‘‘আমলাতন্ত্রের অপরাধ, অপকর্ম সাংবাদিকরা প্রকাশ করে দেয়৷ তাই তাদের ওপর আমলাতন্ত্রের আক্রোশ৷ তারা নানাভাবে সাংবাদিকদের হয়রানি করে৷ মিথ্যা মামলা দেয়৷ এটা করে তারা সরকারের ভাবমুর্তি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করছে৷’’
প্রসঙ্গত এর আগে ২০২০ সালের ১৩ মার্চ কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তখনকার ডিসি সুলতানা পারভীন তাকে দণ্ড দিয়ে জেলে পাঠিয়েছিলেন৷ সুলতানা পারভীন জেলা প্রশাসনের একটি পুকুর সংস্কার করে তার নাম নিজের নামে ‘সুলতানা সরোবর' রেখেছিলেন৷ ওই বিসয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক আরিফুল ইসলামকে মাদক রাখার অভিযোগে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত৷