ওয়েব নিউজ |
ইটালিতে অভিবাসী আটককেন্দ্রগুলো বন্ধ ও প্রশাসনিক আটকাদেশের ইতি ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছে দাতা এবং অধিকার সংস্থাগুলো৷ অভিবাসন থিঙ্কট্যাংক এফআইইআরআই-এর আইনজীবী এবং গবেষক এলিওনোরা সেলোরিয়া আটককেন্দ্রগুলোকে ‘কারাগারের চেয়েও ভয়াবহ’ আখ্যা দিয়ে ইনফোমাইগ্র্যান্টসকে সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন৷
‘‘আমি যদি মারা যাই আমার মরদেহটা যেন আফ্রিকায় ফেরত পাঠানো হয়,’’ ইটালির একটি আটককেন্দ্রের দেয়ালে ফরাসি ভাষায় লিখেছিলেন উসমান সিল্লা৷
ইউরোপের দেশটির রাজধানী রোমের বাইরে অবস্থিত পোন্তে গ্যালেরিয়া অভিবাসী আটককেন্দ্রে গত ফেব্রুয়ারি মাসে আত্মহত্যা করেন সিল্লা৷
তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার পর অনেকের মাঝে শোক নেমে আসে৷ সেই ঘটনায় অনেকে বিক্ষুব্ধও হয়ে ওঠেন৷ অন্যান্য অভিবাসীরা তোষকে আগুন ধরিয়ে দেন এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন৷ ছয় আটক ব্যক্তি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন৷
সিল্লার বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে৷ কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম লিখেছে, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১৯ বছর, কেউ লিখেছে ২২ বছর৷ তবে তার মৃত্যু ইটালিতে অভিবাসী আটককেন্দ্র বন্ধ এবং প্রশাসনিক আটক ব্যবস্থা বাতিলের দাবি জোরালো করেছে৷
তুরিনে ফোরাম অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ইউরোপিয়ান রিসার্চ অন ইমিগ্রেশনের (এফআইইআরআই) আইনজীবী এবং গবেষক এলিওনোরা সেলোরিয়া তাদের একজন যারা এই দাবির সপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইটালির অভিবাসন নীতি সংস্কারের আশুপ্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন৷
‘কারাগারের চেয়েও ভয়াবহ’
অপরাধী আটকেরক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিদের আটক করা হয় যারা কোনো অপরাধ করেছেন৷ কিন্তু প্রশাসনিক আটকাদেশ ইস্যু করা হয় তাদের বিরুদ্ধে যাদের আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হয়েছে বা এমন বিদেশি যারা অপরাধকর্মে জড়ানোয় বহিস্কারের অপেক্ষায় রয়েছেন৷ এসব ব্যক্তিকে বিতাড়নের আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যখন চলতে থাকে তখন তাদেরকে সাময়িকভাবে অভিবাসী আটককেন্দ্রে রাখা হয়৷ ইটালিতে এসব কেন্দ্রকে সিপিআর বলা হয়৷ আশ্রয়ের আবেদনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বা যারা ইটালিতে আশ্রয়ের জন্য আসেননি এমন ব্যক্তিদের সেখানে পাঠানো যায়৷
‘‘এটা এজন্য করা হয় যাতে আপনাকে বহিস্কারে নির্দেশ দেওয়া যায় এবং আপনি যাতে গা ঢাকা দিতে না পারেন,’’ বলেন সেলোরিয়া৷
তিনি জানান, আটককেন্দ্রগুলোতে বসবাসের পরিস্থিতি শোচনীয় এবং সেখানে নজরদারির ব্যবস্থা কারাগারের চেয়েও ভয়াবহ৷
ভারী অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত রক্ষী এবং পুলিশ কেন্দ্রগুলো পাহারা দেন৷ সেখানে অবস্থানরতদের গতিবিধির দিকে নজর রাখা হয় এবং খাদ্য ও পানির মতো নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলেও জানিয়েছেন এই আইনজীবী৷
‘‘কারাগারে পুনর্বাসন এবং সমাজে একীভূতকরণের লক্ষ্য থাকে৷ সেখানে স্বাধীনতাবঞ্চিত মানুষদেরকে এই লক্ষ্য পূরণের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকে৷ কিন্তু অভিবাসী আটককেন্দ্রে আপনি শুধু বহিষ্কার আদেশ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন৷ সেখানে কোনো কর্মসূচি বা সেবা নেই৷ অনেক অভিবাসীই সেখানে তাদের অধিকাংশ সময় কিছুই না করে কাটান,’’ বলেন সেলোরিয়া৷
তিনি গুরুত্ব দিয়ে জানান যে যেসব ব্যক্তির আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হয়েছে তারা কোনো অপরাধ করেননি৷
এই গবেষক বলেন, ‘‘আমি এসব কেন্দ্রের যেসব অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলেছি তারা সবসময় জানতে চান, আমি কী এমন করেছি যার জন্য এই পরিণতি হয়েছে?’’
‘‘প্রশাসনিক আটকাদেশ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আইনবহির্ভূত সহিংসতা৷ এবং এটা কোনো কাজে লাগছে না,’’ বলেন তিনি৷
সেলোরিয়ার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে আটকে রাখা ৬,৩৮৩ জনের মধ্যে মাত্র ৩,১৫৪ জন বা পঞ্চাশ শতাংশেরও কম তাদের নিজ দেশে ফেরত গিয়েছিলেন৷
তিনি মনে করেন, বিতাড়ন নিশ্চিত করতে ভ্রমণসংক্রান্ত নথিপত্র আটকে রাখা প্রশাসনিক আটকাদেশের চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে৷ পাশাপাশি অভিবাসন পরিস্থিতি দ্রুত নিয়মিতকরণ আরো মানবিক উপায় হবে বলেও মনে করেন তিনি৷
আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত
গত বছর ইস্যু করা ডিক্রিগুলোতে অবশ্য ইটালি সরকার অভিবাসীদের আটকাদেশের মেয়াদ আট মাস পর্যন্ত বাড়িয়েছে৷
পাশাপাশি গতমাস আলবেনিয়ার সংসদ ইটালির সঙ্গে একটি অভিবাসন চুক্তি অনুমোদন দিয়েছে৷ ফলে ইটালি আলবেনিয়ার ভূখণ্ডে দুটি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কেন্দ্র চালু করতে পারবে৷
পাঁচ বছর মেয়াদি এই চুক্তি অনুযায়ী, ইটালি আলবেনিয়ায় একটি কেন্দ্রে নতুন আগত অভিবাসীদের যাচাই-বাছাই এবং অন্য কেন্দ্রে আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়াজাতের সময়টাতে তাদের আটকে রাখতে পারবে৷ যাচাই-বাছাই শেষে একজন অভিবাসনপ্রত্যাশী হয় ইটালিতে প্রবেশ করতে পারবেন অথবা তাকে নিজের দেশে ফেরত যেতে হবে৷
শিবির দুটোর প্রতিটিতে ৩,০০০-এর মতো অভিবাসী রাখা যাবে৷ গড়ে একেকটি আবেদন যাচাই-বাছাইয়ে সাধারণত একমাসের মতো সময় লাগে৷ সে হিসেবে প্রতিবছর আলবেনিয়ায় ৩৬ হাজারের মতো অভিবাসী পাঠানো সম্ভব হতে পারে৷
‘‘অন্যান্য দেশ দেখবে আলবেনিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এবং এরকম কিছু তারাও করার চেষ্টা করতে পারে,’’ বলেন তিনি৷
ইউরোপের একাধিক দেশ অভিবাসন নীতি আউটসোর্সিং করার চেষ্টা করায় সমালোচনার মুখে রয়েছে৷ যুক্তরাজ্যও আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠানোর একটি উদ্যোগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে৷
অনিয়মিত অনুপ্রবেশ রুখতে প্রতীকী পদক্ষেপ
প্রশাসনিক আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি ইটালি সরকারের অনিয়মিত অভিবাসীদের প্রতি একটি প্রতীকী কিন্তু পরিষ্কার বার্তা বলে মনে করেন এই আইনজীবী৷ আটককেন্দ্রগুলোতে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মূলত পুরুষদের রাখা হয়৷
সেলোরিয়া বলেন, ‘‘এভাবে দেখানো হচ্ছে যে প্রশাসনিক আটকাদেশে আটক থাকা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা বিপজ্জনক৷ ফলে যারা এখানে আসতে চাচ্ছেন তাদের প্রতি বার্তাটা পরিষ্কার: যদি তুমি আসো, তাহলে তোমাকে শাস্তি দেয়া হবে৷’’