ওয়েব নিউজ |
ইটালির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মোনফালকোনে শহরের একটি পার্কিং লটে জুম্মার নামাজ পড়েন স্থানীয় মুসলিমরা৷ গাদাগাদি করে নামাজ পড়তে গিয়ে নানা অসুবিধার সম্মুখীন তারা৷
গত বছর থেকে তারা মূলত এখানে নামাজ পড়া শুরু করেন৷ কারণ সেসময় কর্তৃপক্ষ শহরে অবস্থিত দুটি মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নামাজ পড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়৷
উল্লেখ্য ২০১৬ সাল থেকে শহরের ক্ষমতায় রয়েছে ডানপন্থি লিগ পার্টি৷ সেই সময় থেকে মেয়রের দায়িত্বে আছেন আনা মারিয়া সিসিন্ট।
শহরের ৩০ হাজার বাসিন্দার এক তৃতীয়াংশই অভিবাসী যাদের অনেকে কয়েক দশক ধরে ইটালিতে বাস করছেন৷
বাংলাদেশি অভিবাসী
শহরটির অভিবাসীদের একটি বড় অংশই বাংলাদেশি যাদের অধিকাংশই মুসলিম৷ ইটালির এই শহরটি ইউরোপের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য সুপিরিচিত৷ যে কারণে এই শহরটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি৷
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, যে জায়গাটিতে এখন মুসলিম পুরুষেরা নামাজ পড়েন সেটি রেজাউল হক নামে এক বাংলাদেশি অভিবাসীর মালিকানাধীন৷
তার অভিযোগ, ‘‘নামাজের জায়গা দেওয়ায় শহর কর্তৃপক্ষ তাকে হয়রানি করছে৷’’
২০০৬ সালে ইটালিতে আসেন রেজাউল হক৷ পরে দেশটির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন তিনি৷ বার্তা সংস্থাকে এই বাংলাদেশি অভিবাসী বলেন, ‘‘বলুন, আমি কোথায় যাব৷ আমাকে কেনো মোনফালকোনের বাইরে যেতে হবে৷ আমি এখানে বাস করি, এখানে কর প্রদান করি৷’’
লা রিপাবলিকা সংবাদপত্রকে এই অভিবাসী আরো জানান, ২০১৮ সালে সাড়ে তিন লাখ ইউরো খরচ করে নামাজ পড়ার জায়গা করতে এই জায়গাটি কিনেছিলেন তিনি৷ এরপর স্থানীয় আইনের পরিবর্তনের কারণে তিনি আর সেটি গড়ে তুলতে পারেননি৷
সেখানে তিনি মসজিদ নির্মাণ করতে চান কি না এমন প্রশ্নের জবাবে রেজাউল হক জানান, তিনি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে চান যেখানে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে৷
মসজিদ নাকি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
স্থানীয় মেয়র অবশ্য হয়রানির বিষয়ে রেজাউল হকের এই অভিযোগ অস্বীকার করেন৷ মোনফালকোনের মেয়র সিসিন্ট বলেন, ইটালির নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় উপাসনালয়ের স্থাপনা তৈরিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘একজন মেয়র হিসেবে আমি কারো বিপক্ষে নই৷ কোনাে ব্যক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে আমি আমার সময়ও নষ্ট করতে চাই না৷ আবার এখানে আমাকে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে৷’’
জানা গেছে, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শহরটির স্থানীয় প্রশাসনিক আদালত মেয়র এবং মুসলিমদের মধ্যস্ততার জন্য এগিয়ে এসেছে৷
ঔদ্ধত্যের প্রকাশ
স্থানীয় মুসলিমদের উদ্ধৃত করে ২ মেনিফেস্টো পত্রিকার খবরে বলা হয়, নামাজ পড়ার বিষয়ে মুসলিমেরা বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিল৷ যেমন কয়েকবার নামাজের জামাত আয়োজন করা যেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভেতরে অতিরিক্ত লোকসমাগম না হয়৷
কিন্তু প্রসাশন এই প্রস্তাবনায় সাড়া দেয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয় মুসলিমদের৷ এরপর রমজান মাসে তারা শহরের কেন্দ্রে খোলা মাঠে নামাজ আয়োজন করতে শুরু করে বলে জানা গেছে৷
এ বিষয়ে ২ মেনিফেস্টো পত্রিকাকে মেয়র সিসিন্ট জানান, তার মনে হয়েছে তিনি এমন এক ধরনের আচরণের সাক্ষি হচ্ছেন ‘যেটি মারাত্মক ঔদ্ধত্যপূর্ণ৷’ মেয়রের মতে, শহরের কেন্দ্রে নামাজ আয়োজনের এই বিষয়টি প্রদর্শন করছে যে, তারা এমন একটি কাজ করছে যা স্থানীয় আইন সমর্থন করে না৷
তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের চাহিদা আসলে এই লোকেদের সত্য চেহারাটি উন্মোচন করে৷ বলতে হয়, তারা তাই করতে চায় যা তাদের ইচ্ছা, তাদের যেভাবে খুশি সেভাবে৷’’
‘সতর্কতার সাথে সামলাতে হবে’
এদিকে বিষয়টিকে মারাত্বক স্পর্শকাতর বলে মনে করছে সেখানকার গোরিজিয়া অঞ্চলের প্রেফেক্ট (প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ)৷ তারা বলছে, পরিস্থিতি স্পর্শকাতর আর তাই এটিকে খুব সতর্কতার সাথে সামলাতে হবে৷
ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠের ইটালিতে ১৩টি ধর্মের দাপ্তরিক মর্যাদা রয়েছে৷ এই তালিকায় ইসলাম ধর্ম নেই৷ আর এ কারণে মসজিদ নির্মাণ করা সেখানে কঠিন৷
দেশটির মুসলিমদের প্রধান সংগঠনের একটি ইটালিয়ান ইসলামিক রিলিজিয়াস কমিউনিটি জানায়, ইটালিতে রাষ্ট্রিয়ভাবে স্বীকৃত মসজিদের সংখ্যা ১০টিরও কম৷ সংগঠনটির সদস্য ইয়াহিয়া জানোরো বলেন, ‘‘অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে আলাদা করে ফেলা হলে তা অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ইসলাম বিষয়ে কুসংস্কার এবং ভয় তৈরি করতে পারে৷’’
এদিকে মোনফালকোনের মসলিমেরা জানান, ঘৃণা না হলেও এরইমাঝে স্থানীয়দের মধ্যে তাদের প্রতি অবিশ্বাসের এক ধরনের পরিবেশ অনুভব করছেন তারা ৷
‘মা, আমরা মুসলিমরা কি খারাপ?’
৩৮ বছরের আহমেদ রাজু একটি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন৷ জানালেন, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিতে সীমাবদ্ধতা থাকায় তিনি মূলত বাসাতেই নামাজ পড়েন৷
বার্তা সংস্থা এএফপিকে এই অভিবাসী জানান, ‘‘আপনার মনে হবে, আপনি বড় একটি দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যা আপনি ভাঙতে পারবেন না৷ আমরা বিদেশি৷ আমরা পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে পারি না৷’’
স্থানীয় আরেক মুসলিম শারমিন ইসলাম জানান, ইটালিতে জন্ম নেওয়া তার ছোট ছেলে স্কুল থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, ‘‘মা, আমরা মুসলিমেরা কি খারাপ?’’
যদিও মেয়র সিস্টিন বললেন তিনি কারো বিরুদ্ধে নন, তবে তার মতে, ‘‘ইটালিয়ানদের তুলনায় জন্মহার বেশি হওয়ার কারণে শহরটিতে মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা এই শহরটির জন্য অনেক বেশি হয়ে গেছে৷’’
গত ডিসেম্বর থেকে পুলিশ প্রহরায় আছেন এই মেয়র৷ কেননা অনলাইনে তাকে বেশ কয়েকবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল৷
মোনফালকোনের মুসলিম সম্প্রাদয় ‘উন্মুক্ত নয়’ জানিয়ে মেয়র বলেন, তিনি মনে করেন, মুসলিমদের বিভিন্ন সামাজিক কেন্দ্রে আরবি নয় ইটালিয়ান ভাষা শেখানো উচিত৷
এই মেয়র বলেন, ‘‘এটি অসহনীয় যে, কোনো কোনো মুসলিম নারীকে মনে হয় জোর করে তাদের স্বামীর পেছনে হাঁটতে বলা হয় কিংবা কিছু মুসলিম মেয়ে স্কুলে বোরখা পরে আসছে৷’’
‘বোরখা ব্যক্তিগত পছন্দ’
মোনফালকোনের একটি মুসলিম পরিবারে লাউরার জন্ম৷ লা রিপাবলিকা পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘‘বোরখা পরার বিষয়টি প্রতিটি ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ এবং এটি একজন মানুষ ভেতরের বিশ্বাস থেকেই আসা উচিত৷’’
এদিকে লা রিপাবলিকা পত্রিকাকে বাংলাদেশি অভিবাসী রেজাউল হক বলেন, ‘‘ইসলামিক পোশাক পড়া মানেই একজন ব্যক্তি সমাজে একীভূত হওয়ার বিরোধী কিংবা তিনি কট্টরপন্থি বিষয়টি এমন নয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এই দুটি আলাদা বিষয়৷ আমরা কাউকে বিরক্ত করতে চাই না৷ আমরা এই সমাজের অংশ হতে চাই৷’’
তবে মেয়র সিসিন্ট বলেন, ‘‘এখানে অনেকে রয়েছেন … আপনাকে এটি যেমন আছে তেমনই বলতে হবে৷’’
গত মার্চে ‘ইনাফ অলরেডি: ইমিগ্রেশন, ইসলামাইজেশন অ্যান্ড সাবমিশন’ নামে একটি বই লেখেন সিসিন্ট৷ অনলাইনে বইটির সারসংক্ষেপে তার বিষয়ে বলা হয়, মোনফালকোনের সাহসী মেয়র, মৃত্যুর হুমকি এবং পুলিশি সুরক্ষা৷
জানা গেছে, চলতি মাসের শেষ দিকে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দুটিতে মুসলিমেরা নামাজ পড়তে পারবেন কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে আদালত৷